
নওরিন তামান্না
‘সোনালি আঁশ’ অর্থাৎ পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মাটির গুণাগুণ ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট উৎপাদিত হয়। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পাট মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে বর্তমানেও পাটের উৎপাদন রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৪৫ লাখ কৃষকের সম্পৃক্ততায় দেশে প্রায় ৯০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপাদিত হচ্ছে। যা বিশ্বে মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। ইউরোপের ২৮টি দেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ করে টেকসই, পরিবেশবান্ধব, সবুজ উন্নয়নের লক্ষ্যে পাটপণ্য ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেটা আমাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেও বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। আমাদের জিডিপির মাত্র তিন-চার শতাংশ আসে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। এর অন্যতম কারণ ৮০-৯০ শতাংশ কাঁচা পাট আমরা রপ্তানি করি আর বাকি সামান্য সংখ্যক পাট আমরা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে পাটপণ্য তৈরিতে সক্ষম হই। অন্যদিকে রপ্তানিকৃত কাঁচা পাটের সিংহ ভাগই কিনে নেয় ভারত। সেসব কাঁচা পাট নিজেদের অত্যাধুনিক মেশিনে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করছে তারা এবং বিশ্ব বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাটপণ্য রপ্তানি করে অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুনাফা। পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের সমকক্ষ হলেও পাটজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার দখলের ক্ষেত্রে ভারত অনেক এগিয়ে। প্রসঙ্গত, আঠারো শতকের পরে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি তথা ইউরোপের পাটকলগুলো বাংলার পাট রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাংলার পাট দিয়েই ইউরোপে তৈরি হয় জুট ব্যারন নামক ধনিক শ্রেণি।বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ হয়েও আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে লাভবান হতে পারছি না। বর্তমানে দেশে ৩০৭টি পাটকলের মধ্যে সরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৫টি এবং বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮২টি। বেসরকারি পাটকলগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করে সচল থাকলেও সরকারি পাটকলগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বিজেএমসির তত্ত্বাবধানে সরকারি পাটকলগুলো বিগত ৪৮ বছরের মধ্যে চার বছর কিছুটা লাভ দেখাতে পারলেও বাকি ৪৪ বছর অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে এসেছে। ফলস্বরূপ প্রতি বছর সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে কলগুলো সচল রাখতে হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তথাপি সরকারকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয়েছে। হয়েছে শ্রমিক আন্দোলনও। তাই গত ১ জুলাই ‘শতভাগ’ পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে, ২৪ হাজারের অধিক শ্রমিককে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ এর আওতায় এনে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। যখন বৈশ্বিক বাজারে পাট পণ্যের স্বর্ণালি সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে এবং পাট উৎপাদনকারী দেশগুলো সেই সুযোগ লুফে নিচ্ছে, তখন দেশজ পাটকল বন্ধের ঘোষণা আমাদের হতাশ করে। সরকারি পাটকল সমূহের লোকসানের প্রধান কারণ হিসেবে বিজেএমসির অব্যবস্থাপনা, সময়মতো পাট কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব ও দুর্নীতিকে বিশেষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। এছাড়াও নেতৃত্ব ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অভাব, বৈশ্বিক বাজার দখলে কৌশলগত ত্রুটি, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, অদক্ষ ও বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগের ফলে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই পাটকলগুলোকে। ফলে কলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সরকার। এদিকে, সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় পাটের বাজার সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। ফলে মৌসুমের পাট বিক্রি করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষক। কৃষি অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এবার দাম না পেয়ে চাষিরা পাট চাষে আগ্রহ হারালে উৎপাদন কমে যাবে। তাতে পাট সংকটে পড়বে বেসরকারি পাটকলগুলোও। কিন্তু এতে শুধু পাটকলের সঙ্গে জড়িত কৃষক ও শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং আমরা উন্নতির স্বর্ণালি সুযোগকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। পৃথিবী এখন প্রকৃতি ও পরিবেশকে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং পাটশিল্পে সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। আর ঠিক এইরকম বৈশ্বিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমাদের পাটশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা খুঁজতে হবে? পরিবেশবান্ধব পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের উন্নতি অন্যদের হাতে তুলে না দিয়ে, কাঁচাপাট রপ্তানির পরিমাণ কমিয়ে এনে নিজেরা প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। তাই পাটকলগুলো ক্রমশ খুলে দিয়ে, পাটশিল্পের প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটাই সময় নিজেদের কাঁচামাল ব্যবহারে সমৃদ্ধি অর্জন করার, উন্নত দেশ গড়ার।
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়