
পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। পাট উৎপাদনকারী পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভালো। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট এবং পাটজাতীয় (কেনাফ ও মেস্তা) ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৫৭ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি পাটের আঁশের মান, দৈর্ঘ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী চারটি জিনের পেটেন্ট (কৃতিস্বত্ব) পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এছাড়া ক্ষতিকারক ছত্রাক Macrophomina phaseolina-এর তিনটি জিন শনাক্ত করে সেগুলোর পেটেন্টও পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্মোচিত জীবনরহস্যের এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে স্বল্প জীবনকালসমৃদ্ধ, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম, রোগবালাই সহনশীল, বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য উৎপাদন এবং উচ্চফলনশীল পাটের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা এগিয়ে চলছে।
একদিকে সোনালি আঁশ, অন্যদিকে রুপালি কাঠি- দুয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট। পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীপণ্য। প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠির অর্ধেকও যদি সঠিকভাবে চারকোল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। ভেষজ হিসেবে পাটপাতা বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চা’য়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিজেআরআই) পাটের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু করে এবং বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় গুয়ার্ছি অ্যাকুয়া অ্যাগ্রো টেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান পাটের পাতা দিয়ে তৈরি অর্গ্যানিক চা জার্মানিতে রফতানি করছে। সম্প্রতি পাটের পাতা থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন সবুজ চা উৎপাদন বড় পরিসরে শুরু করতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আঁশ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্য তেল এবং মেস্তার মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি প্রস্তুতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাটে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সেলুলোজ রয়েছে। পাট থেকে পাল্প তৈরি করে পুনরায় সেলুলোজ রি জেনারেট করে ভিসকস তৈরি করা সম্ভব। আর এই ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের প্যাভিলিয়নে পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাটের তৈরি বিশেষ সোনালি ব্যাগ ও পাটপাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় মেলায় আগত দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পে কাপড় তৈরির উপযোগী সুতা বর্তমানে পাট থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। কম লিগনিনসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন সম্ভব হলে বস্ত্র শিল্পে তুলার বিকল্প হিসেবে অথবা তুলার সঙ্গে সংমিশ্রণে পাটের ব্যবহারে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। বিজেআরআই’র যুগান্তকারী পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে চাহিদামাফিক (কৃষিতাত্ত্বিক/পণ্যভিত্তিক) পাটের জাত উদ্ভাবন এবং পাট ও ছত্রাকের সাতটি জিনের পেটেন্ট কাজে লাগিয়ে শিল্পের উপযোগী পাটপণ্য উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর কদর আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুবাদে পাট ও পাটজাত পণ্যের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার হতে থাকে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। সাম্প্রতিককালে ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতিমাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক আঁশের তৈরি ব্যাগের প্রয়োজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বর্তমানে প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।
পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার সম্প্রতি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্বুদ্ধকরণে পাট আইন, ২০১৭ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। পাটচাষীদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ১৬টি বাণিজ্যিক বাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পাটকল মালিকদের অনুরোধে সরকার তিন ধরনের কাঁচা পাট রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা পাটশিল্পের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) ১৩৫ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ৪৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০ কোটি ৬০ লাখ পিস পাটের বস্তা সরবরাহ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাটচাষীদের পাটের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর পরিচালনাকারী সংস্থা বিজেএমসি গত মৌসুমে ১ হাজার কোটি টাকার পাটআঁশ ক্রয় করেছে। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সরকার ৬ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো দেশব্যাপী জাতীয় পার্টি দিবস উদযাপন করছে।
পাট চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে বিজেআরআই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)-এর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পাট স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজার মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেহেতু বিশ্বসেরা পাট বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, সেহেতু সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের পাট নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কৃষিবিদ মো. আল-মামুন : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা