
প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, ০৬ মার্চ ২০১৮
সোনালী আঁশের সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ। আজ জাতীয় পাট দিবস। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ থেকে জাতীয়ভাবে ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস পালন করা হচ্ছে। আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গর্বিত বাহন বাংলার সোনালী আঁশ পাট। পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনকারী খাত।
পাটের ভূমিকা অবদান স্বীকৃত ইতিহাস। দেশের ০৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপন্ন হয়। বছরে উৎপাদিত পাট আঁশের শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ ভারী পাটকল গুলোতে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচাপাট বিদেশে রফতানি হয় ও মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। গত ৭০ বা ৮০ দশকের তুলনায় বাংলাদেশে পাটের আবাদের জমি কমে গেলেও গত ৫-৬ বছরে আবার তা বাড়ছে আশাতীতভাবে।
পাট বহুগুণে গুণান্বিত ফসল। মাটির উবর্রতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড়তি জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মেটাতে বেশি পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্যশস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাটের উর্বর আবাদী জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এর প্রধান কারণ পাট গবেষণায় উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশল ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণনের সাথে জড়িত। এ ছাড়াও কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রফতানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। পাট ফসল দেশের কর্ম সংস্থানে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ পাটচাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া পাট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পাটের আঁশ পচার পর আঁশ ছাড়ানো, ধোয়া ও শুকানো কাজে কৃষক পরিবারের মহিলা সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি দেশের মহিলা বিনিয়োগী কর্মসংস্থানের এক বিরল উদাহরণ।
পাটের আঁশ বিক্রির টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখে, গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরবর্তী রবি শস্য চাষের আর্থিক মোকাবেলা করার সাহায্য করে পাট চাষ। তাছাড়া পাটের অবদানের এভিনিউতে আছে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কুটির শিল্প, নারী উদ্যোক্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামের আধুনিকায়ন, অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ, দেশের গৌরব বিশ্ব দরবারে উজ্জলতরকরণে পাটের অবদান ব্যঞ্জরিত।
দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বাড়ার সাথে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বিপুল জনগোষ্ঠী ও প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য কৃষক ঝুকছে খাদ্য ফসল উৎপাদনের দিকে। ফলে পাট চাষের জমি চলে যাচ্ছে প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে। সত্তর দশকের আগে পর্যন্ত পাট আবাদের ক্ষেত্রে দেশি ও তোষা পাটের অনুপাত ছিল ৮০:২০। গবেষণা ও আধুনিক ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণে সারা দেশে উৎপাদন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটানোর মাধ্যমে, বর্তমানে দেশি ও তোষা আবাদের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০:৮০। এ কারণেই প্রভাবেই পাটের গড় ফলনশীলতা বেড়েছে। সত্তর দশকের দিকে যেখানে পাট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির প্রায় ৭/৮ শতাংশ ও জমির পরিমাণ ছিল ১০-১২ লাখ হেক্টর, কিন্তু খাদ্য ঘাটতি চহিদার জন্য দাঁড়িয়েছে মোট জমির প্রায় ৪/৫ শতাংশে। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে বেশি ফলন নিশ্চিত করাই এ অবস্থা থেকে উত্তরনের একমাত্র উপায়।
বর্তমানে পাটের গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ২ মেট্রিক টন। তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। এলক্ষ্যে পাটবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টরা পাটের উৎপাদন ফলন বাড়ানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাট নিয়ে আমরা আবারো বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর কারিশমা দিয়ে। পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে ব্যবহারে আমরা অগ্রাধিকার দেবো সর্বোতভাবে এ ব্যাপারে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।
পাট পরিবেশবান্ধব বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। শিল্প বিপ্লবের সময় ফ্লাক্স এবং হেম্পের স্থান দখল করে পাটের যাত্রা। বস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পাট এখনও গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সাথে মিশ্রণ করে ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। টেক্সটাইল প্রচলিত বয়ন শিল্পে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং, পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, মনোহরি দ্রব্যাদি, কুটিরশিল্প, ঘরোয়া উপকরণ এসব পাটেরই অবদান। গরম কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনে কাপড় তৈরির জন্য উলের সাথে মিশানো হয়। কৃষিপণ্যের মোড়ক, অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়। পাটখড়ি পাট চাষের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ খড়ি উৎপাদিত হয়। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রঙ এসব। পাটখড়ি জ্বালানি, ঘরের বেড়া, ঘরের চালের ছাউনীতে এবং জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হয়। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসাবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাট খড়ি ব্যবহৃত হয়।
সোনালি আঁশ পাট বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। যুগযুগ ধরে এ দেশের কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতার মূলে ছিল পাট। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট বাংলার মানুষের জীবনমানে যতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছিল অন্য কোনো ফসলের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বাংলায় উৎপাদিত পাটের প্রতি ইউরোপ আমেরিকা ঝুঁকে পড়েছিল।