
ঢাকা অফিস ॥
সোনালি আঁশখ্যাত পাটের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি আয়ের এই খাত এখন পাট সংকটে ধুঁকছে। ইতিমধ্যে কাঁচা পাটের অভাবে ৩০০ পাটকলের মধ্যে প্রায় ৫০টি বন্ধ হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি দামের কারণে লাভ হওয়ার পরও পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। আর এর পেছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাট পচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব এবং পাটের দামে মজুদদারদের কারসাজির কারণে লোকশানের শঙ্কা। এছাড়া পাট বীজ আমদানিনির্ভর হওয়ায় প্রতি বছরই ঝুঁকিতে থাকে উৎপাদন কার্যক্রম।
পাটপণ্য রপ্তানিকারকরা বলছেন, পাটে এমন অস্থিরতা চললে আগামীতে মুখ থুবড়ে পড়বে এ খাতের রপ্তানি আয়। তখন আন্তর্জাতিক বাজার চলে যাবে প্রতিবেশীদের দখলে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দাবি করেছে, পাট চাষ বাড়াতে ও পাটের বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়। সেখান থেকে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। অধিদপ্তর দাবি করছে, সেখান থেকে ৮০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৮২ লাখ ৮৩ হাজার টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে চাষ হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে, যেখান থেকে ৭৭ লাখ টন পাট পাওয়া গেছে।
যদিও অধিদপ্তরের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করছেন পাটকল মালিকরা। তাদের দাবি, যদি এ পরিমাণ পাট উৎপাদন হতো তাহলে বাজারে পাটের সংকট দেখা দিত না। অবশ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তাই উৎপাদনের পরিমাণ পরিসংখ্যানের চেয়ে কম হবে। যদিও তারা এটাও বলছেন, পাট অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে সমন্বিতভাবে এ পরিসংখ্যান করা হয়েছে।
যে কারণে কমছে পাটের চাষ :
গত দুই বছর ধরে বাজারে কাঁচা পাটের দাম বেশ ভালো যাচ্ছে। এ বছর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মণপ্রতি পাট বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার টাকার ওপর। ফেব্রুয়ারিতে কাঁচা পাটের মণপ্রতি দাম ৭ হাজার টাকায় পৌঁছায়। পাটের দামের এমন উত্থানে মজুদদারদের কারসাজি থাকলেও কৃষকরাও এবার তুলনামূলক ভালো দাম পেয়েছেন। কিন্তু এরপরও পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। পাটচাষি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাট চাষে আগ্রহ কমার অন্যতম একটি কারণ পাট পচানোর জন্য পানির অভাব। এছাড়া প্রতি বছর পাটের দামের অস্বাভাবিক ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় কৃষকদের লোকসানের কবলে পড়তে হয়। তাই কৃষকরা এখন পাটের বদলে অন্য যেকোনো দুই ফসল ফলানোর দিকে মনোযোগী হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে ময়মনসিংহ অঞ্চলে অনেক কৃষক পাট চাষ করতেন। কিন্তু এখন জলাধারগুলোতে মাছ চাষ করা হয়। এজন্য পাট পচানোর মৌসুমে আর পানি পাওয়া যায় না। ফলে পাট শুকিয়ে যায়। কাঁচা পাটের দাম ভালো থাকলেও পচানোর অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকদের লোকসানে পড়তে হয়। এমন অবস্থা কিন্তু সর্বত্র। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর অঞ্চলেও কৃষক এখন আর সেভাবে পাট চাষে আগ্রহ দেখায় না। পদ্মার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন শুকনা মৌসুমে জলাধারে আর পানি থাকে না। সব মিলিয়ে একটা সংকটময় অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে পাট খাত।’
ফরিদপুরের পাটচাষি নাঈম ইসলাম বলেন, ‘দাম ভালো, বেনিফিটও বেশি। কিন্তু পচাতে না পারলে লাভ আসবে কীভাবে? পাট লাগানো (বীজ বপন) থেকে পচানো পর্যন্ত যে সময় লাগে সেই সময়ে দুই ফসল চাষ করা যায়। এজন্য পাট চাষের জমি কমিয়ে দিয়েছি।’
একই জেলার পাটচাষি ওয়ালি উল্লাহ বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমরা পাট চাষ করি। আগে কখনো পাট পচানোর জন্য পানির সংকট ছিল না। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে পানি সংকট বেড়েই চলছে। শুকনার সময় নদীর পানি অনেক কমে যায়। এতে ডোবার (জলাশয়) পানিও থাকে না। তখন পাট পচানোর জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। এর চেয়ে ভালো পেঁয়াজ মৌসুমে পেঁয়াজ আবার এর পরে অন্য একটা ফসল চাষ করছি। গত ১০ বছরে আমার পাট চাষের জমির পরিমাণ অর্ধেকে কমিয়ে দিয়েছি।’
ঝুঁকিতে বীজ আমদানি : বাংলাদেশের পাট বীজের প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। আর এর পুরোটাই আসে ভারত থেকে। পাট খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীও ভারত। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাট মৌসুম এলেই তাদের বীজ নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। এছাড়া বীজের মান নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে। সময়মতো বীজ সরবরাহ নিয়ে অধিদপ্তরের একটি বিভাগের নিয়মিত কাজ করতে হয়। বাংলাদেশ যে বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে সেই সুযোগও কম। যদিও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
এদিকে ভারত আগামী মৌসুমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে পাটের বীজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে এমন খবর চাউর হচ্ছে পাটকল মালিকদের মধ্যে। এমনটি হলে পাট উৎপাদনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে ইতিমধ্যে অধিকাংশ বীজ আমদানিকারক আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তরা জানিয়েছেন, প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার ২০০ টন পাট বীজ আমদানির প্রয়োজন পড়ে। এর মধ্যে ৭০০-৮০০ টন দেশেই উৎপাদিত হয়। ইতিমধ্যে চার হাজার টন বীজ আমদানি সম্পন্ন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বীজ ও অন্যান্য উপকরণ) ড. সুরজিত সাহা রায় বলেন, ‘ভারত থেকে সময়মতো বীজ পাব কি না এ নিয়ে আমাদের প্রতি বছর চিন্তায় থাকতে হয়। আবার নিয়মিত পাট উৎপাদন কমায় আমদানিকারকরাও অতিরিক্ত আমদানি করতে চান না। আমাদের দেশের পরিবেশ বীজ উৎপাদনের জন্য অতটা উপযুক্ত নয়। এছাড়া লাভ কম হওয়ায় কৃষকরাও তেমন একটা আগ্রহ দেখান না। সব মিলিয়ে একটা সংকট আছে। তারপরও সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে বীজ উৎপাদন বাড়ানো যায়।’ এ বছর পাট বীজে সংকট হবে না বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
ওই অধিদপ্তরের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘ভারত পাট বীজ উৎপাদন করে আমাদের জন্য। কিন্তু প্রতি বছরই বাড়তি দাম আদায়ের লক্ষ্যে টালবাহানা করে। আমাদেরও বিকল্প নেই। এছাড়া বীজের মান কেমন হবে তা নিয়ে একটা সংশয় তো থাকেই। আমরা যদি অন্তত ৬০-৭০ শতাংশও উৎপাদন করতে পারতাম তাহলেও এ সুযোগ পেত না। যেহেতু পাটের বীজে লাভ কম তাই সরকারের উচিত কৃষকদের থেকে বাড়তি দামে বীজ কিনে কম দামে কৃষকদের দেওয়া। এতে আমাদের চাপ কিছুটা কমবে।’
বাড়তি দামে বন্ধ হচ্ছে কারখানা : এদিকে পাটের অস্বাভাবিক দাম ও সরবরাহ সংকটে চরম বিপাকে পড়েছে পাটকল মালিকরা। ইতিমধ্যে পাটের অভাবে প্রায় অর্ধশত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পথে আরও কিছু কারখানা। এমন পরিস্থিতিতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিনা শুল্কে পাট আমদানির জন্য ‘নজিরবিহীন’ অনুমোদন চেয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পাটকল মালিকদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ)। একই সঙ্গে তারা পাট মজুদদারের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার আহ্বানও জানায়। সরকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মুজদকৃত পাট উদ্ধার করে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। মূলত সরবরাহ সংকটের কারণেই এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বিজেএমএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘পাট অধিদপ্তর যে পরিমাণ পাট উৎপাদনের তথ্য দিয়েছিল, তা হয়নি। এজন্য বাজারে পাটের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আবার প্রায় চার লাখ বেল (১ বেল সমান ২১৭ দশমিক ৭২ কেজি) পাট রপ্তানি হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা ভয়াবহ।’
কাঁচা পাটের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন পাটপণ্য রপ্তানিকারকরাও। নিয়মিত পাট রপ্তানিতে দেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাড়তি দামে কাঁচামাল কেনায় তা পণ্যের দামে যুক্ত হচ্ছে। এজন্য রপ্তানি আয় বেশি হচ্ছে। তবে পরিমাণ হিসেবে রপ্তানি কমেছে। এ কারণে লাভের পরিমাণও আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ক্রেতারা এখন নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়াও কমিয়ে দিয়েছেন। পাটপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট গুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ইসরাত জাহান বলেন, ‘আমরা দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক। এ খাতের সঙ্গে কোটি মানুষ জড়িত। তাই সরকারকে যেকোনোভাবেই হোক কৃষকদের পাট উৎপাদনে উৎসাহ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মজুদদারি রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে পাটের দাম কমিয়ে আনতে হবে।’